ভাটির পুরুষ আর উজানধলের ওরস
শাকুর মজিদ::
পীর ফকিরের বাড়িতে বছরে এক-দুবার যে উৎসব হয়, এটা ওরস হিসেবেই পরিচিতি পায়। শাহ করিমকে পীর বলেও ডাকেন অনেকে, তার বাড়িতে ওরস না হয়ে কি পারে!
আবদুল করিম ওরস করতেন বছরে একবার, ১৫ চৈত্র। এ দিনটাকে তিনি উৎসর্গ করতেন তার মুর্শিদ মওলা বক্স মুনসীকে উদ্দেশ করে। এ তারিখটি পরিবর্তিত হয় সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন তার বাবা ইব্রাহিম আলীর মৃত্যু হয়। বাবার মৃত্যুদিন ছিল ১৮ ফালগুন। সে কারণে ১৫ চৈত্রের বদলে ১৮ ফালগুন বার্ষিক ওরসের দিন পরিবর্তিত হয়। ১৯৯১ সাল থেকে এর সঙ্গে যুক্ত হয় আরেকটি তারিখ। তার প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছিল ১৩৯৭ বাংলার (১৯৯০ সালের) পৌষ মাসের প্রথম শুক্রবার। সে থেকে ১৮ ফালগুন আর পৌষ মাসের প্রথম শুক্রবার, এ দুটো দিনই তার বাড়িতে উৎসবের আয়োজন হয়। প্রচলিত ভাষায় এটাকে ওরস বলে। এ ওরস উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তার শিষ্যরা এসে হাজির হন। উৎসাহী অনেক শুভানুধ্যায়ীরও আগমন হয় এ উপলক্ষে। বাউল সাধক শিল্পীরা বেহালা, দোতরা নিয়ে আসেন, অন্যরা যে যা পারে হাতে করে আনে। একেবারে খালি হাতে আসেন না কেউই। যা নিয়ে আসা হয়, সবাই মিলে তা-ই খান। দিনভর চলে খানা-দানা, বৈঠকি আড্ডা, তালিম আর রাতভর চলে গান। এই হচ্ছে ওরসের মোটামুটি একটা চরিত্র।
একবার খবর নিয়ে জানা গেল, তার বাড়িতে আগামীতে যে ওরসের আয়োজন হবে, তা হচ্ছে ২০০৪ সালের ১২ মার্চ। কিন্তু এবার কোনোভাবেই নিজের সময় বের করতে পারি না। তাই বলে ওরসের ফুটেজ না পেলে কেমন হয়? ঠিক হলো টিপু ঢাকা থেকে ক্যামেরা ও ক্যামেরাম্যান নিয়ে চলে যাবে উজানধলে। তপু আছে ওখানে, ওরা মিলে মিশে কভার করবে এই আয়োজন।
আমি ঢাকায় বসে ফুটেজ দেখি। ওরসের সময় করিম সাহেবের বাড়িতে শত শত ভক্তের সমাগম হয়। খালি হাতে কেউ আসে না। তরিতরকারি, ফলমূল, হাঁস-মুরগি, (হয়তো গরু-ছাগলও) নিয়ে আসে তারা। ভিডিওতে দেখলাম, করিম সাহেব ঘরের বাইরে, তার উঠানে একটা চেয়ারের ওপর বসে আছেন, আর ভক্তরা একে একে আসছেন, তাকে সালাম করছেন, মোলাকাত করছেন। কেউ কেউ পায়ের কাছে লুটিয়েও পড়ছেন। করিম তাদের আশীর্বাদ করছেন।
সেদিন সন্ধ্যা থেকেই বাড়ির সামনের মাঠে শামিয়ানা টাঙিয়ে রাখা মঞ্চে বাউলেরা একে একে উঠে গান করেন। গানের আসর চলে শেষ রাত পর্যন্ত। এই ফুটেজে একজন নতুন বাউলকে আমি দেখি শাহ করিমের পাশে। তার নাম আবদুর রহমান। আবদুর রহমান শাহ করিমের অনেক পুরনো শিষ্য। কিন্তু যে কদিন আমি এসেছি, তার সঙ্গে আমার দেখা হয় না। আমি ভাবি, একে একে শাহ করিমের শিষ্যদের খবরও নেব।
পুনশ্চ: ২০০৬ সাল থেকে শাহ আবদুল করিমের আরেকটি উৎসবের সূচনা হয়। ফালগুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার ছিল শাহ আবদুল করিমের জন্মদিন। পিতা ও স্ত্রীর মৃত্যুদিনকে কেন্দ্র করে যে ওরসের আয়োজন হতো, বাংলালিংকের পৃষ্ঠপোষকতায় তাতে যোগ হলো শাহ আবদুল করিম উৎসব। ধলগ্রামে শাহ আবদুল করিমের বাড়ির পাশে কালনী নদীর তীরে শামিয়ানা টাঙিয়ে আয়োজন করা হয় বাউল উৎসবের। ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে ছিল এর প্রথম আয়োজন। দিরাই থেকে তপু আহমেদ আমার জন্য পুরো অনুষ্ঠানের ভিডিও ধারণ করে পাঠায়। পরবর্তী বছরগুলোতে একই কো¤পানির পৃষ্ঠপোষকতায় ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহের কোনো একদিনে এ উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে।
ভাটির পুরুষ প্রচার ও ডিভিডি প্রকাশনা :
বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমার এক অনুরাগী আছেন। তার নাম খ. ম. হারুন। তেমন কোনো কারণ ছাড়াই তিনি আমার ভ্রমণ কাহিনী আর ভ্রমণ চিত্র খুব পছন্দ করে ফেলেন। যখন আরটিভিতে ছিলেন, আমার বানানো ‘পৃথিবীর পথে পথে’ নামক ভ্রমণচিত্র চালানোর সুযোগ দিয়েছেন ৬৫ পর্ব পর্যন্ত। তিনি চলে আসার পর বাকিরা এটা আর চালাতে চাইলেন না। তিনি এসেছেন তার পুরনো কর্মক্ষেত্র বাংলাদেশ টেলিভিশনে। ১৯৭৭ সালে এখানেই ‘প্রযোজক’ হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা থেকে এসে। এখন ওখানে আবার যোগ দিয়েছেন উপমহাপরিচালক হিসেবে। আমার ভ্রমণচিত্র বিটিভিতে গছানো যায় কিনা, এই নিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করতে গিয়েছি। তিনি আমাকে বলেন, আপনার ‘ভাটির পুরুষ’-এর খবর কী?
কলকাতায় ভাটির পুরুষের শো করার খবর ঢাকায় চাউর হয় ভালোভাবেই। সেখান থেকেই খবর পাওয়া তার।
আমি হারুণ ভাইকে বলি, মোটামুটি রেডি, একটু ঠিক করতে হবে। তিনি বলেন, কদিন লাগবে? ‘২/৩ দিন’।
‘ঠিক আছে জমা দিয়ে দেন। দেখি, পারলে পহেলা বৈশাখে আপনারটা দিয়ে দেব।’
বলে কী! পহেলা বৈশাখের বাকি মাত্র ২ সপ্তাহ।
এক সন্ধ্যায় হারুন ভাইয়ের ফোন আপনার ডকুমেন্টারি প্রিভিউ কমিটি পাস করেছে। কাল এসে চিঠি নিয়ে যান। তিন দিনের মধ্যে বুকিং মানি জমা দিতে হবে। স্পন্সর পাবেন তো?
‘জি, হারুণ ভাই স্পন্সর পাব।’
কিন্তু আলটিমেটলি স্পন্সর পাওয়াও তো সহজ কাজ ছিল না আমার। এ বিষয়টি আমি নিজে কখনো ডিল করিনি। তিন-চারজনের সঙ্গে কথা বলে যার কাছ থেকে সর্বোচ্চ মূল্য পাওয়া গেল, সে কোম্পানির নাম বাংলালিংক। তারা আমাকে দেবে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এখান থেকে ১৫ হাজার বাদ যাবে। আমার পকেটে ঢুকবে ১ লাখ ৩৫ হাজার, প্রচারের ২ মাস পর।
একবার হিসাব নিয়ে বসেছিলাম। গত ৭ বছরে এর পেছনে আমার নিট খরচের পরিমাণ ৪ লাখের বেশি। সেই টাকাটা পেলেও হয়। নিজের পরিশ্রম না হয়, নাই নিলাম। কিন্তু বাজারের বাস্তবতা আমাকে মেনে নিতেই হয়। আমি রাজি।
২০০৯ সালের ১৪ এপ্রিল (১ বৈশাখ) রাত ১০টার ইংরেজি সংবাদের পরপরই প্রচার হয় ‘ভাটির পুরুষ’।
আমি করিমপুত্র শাহ নূর জালালের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এখন নিশ্চয়ই তাদের বাড়িতে টেলিভিশন আছে!
বাবুল ভাই বলেন, বাবা তো হাসপাতালে।
‘তাহলে ভাটির পুরুষ দেখবেন না?’
‘ব্যবস্থা করছি।’
‘ভাটির পুরুষ’ প্রচার শেষ হয় রাতে। আমি বাবুল ভাইর কোনো ফোন পাই না। তবে কি তারা খুশি হননি?
পরদিন বিকেল বেলা ফোন করি। বাবুল ভাই বলেন, নূরজাহান পলিক্লিনিকের কেবিনে কাল রাতে এটা দেখার ব্যবস্থা করি বাবাকে। বাবা কিছুক্ষণ মাত্র দেখলেন, আর দেখেননি।
‘কী বলেন!’
‘যখনই বাবার চেহারা দেখাল, প্রথম বাবার গান আসল, বাবা কান্না শুরু করলেন। আর কিছুই দেখলেন না।’
ফোনের এপ্রান্তে আমি অনেকক্ষণ নীরব থাকি।
মরমী শিল্পী শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে আলোচিত তথ্যচিত্র ভাটির পুরুষের নির্মাতা শাকুর মজিদের বই ‘ভাটির পুরুষ-কথা’। গুরুত্ববিবেচনায় বইটির নির্বাচিত দুটি টুকরো প্রকাশিত হলো শাহ আবদুল করিমের প্রয়াণদিবসে। বইটি প্রকাশ করেছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ